তোমরা লাটু বা বল দেখেছ । টেবিলের ওপর লাটু বা বলটা ঘুরিয়ে দিলে দেখবে তাদের মাঝখান দিয়ে একটা অদৃশ্য রেখা ( অক্ষ ) ঘিরে সেগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে । আমাদের পৃথিবীও সূর্যের সামনে নিজ অক্ষ বা মেরুরেখার চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে । পৃথিবীর এই ঘোরাকে আমরা আবর্তন গতি বলি । সুর্যের আকর্ষণে পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট পথে সূর্যের চারদিকে অবিরাম ঘুরছে । পৃথিবীর এই ঘোরাকে আমরা পরিক্রমণ বলি ।
পৃথিবীর গতি :
মহাকাশে অন্যান্য গ্রহদের মতো পৃথিবীও স্থির নয় । সূর্যের আকর্ষণে তার সামনে পাক খেতে খেতে একটি নির্দিষ্ট পথে একটু একটু করে সরে যায় । তাই পৃথিবীর নিজস্ব ২ টি গতি আছে ।
পৃথিবীর আবর্তন এবং পরিক্রমণ গতি |
১. আবর্তন গতি ( Rotation speed) :
পৃথিবীর নিজ অক্ষ বা মেরুদণ্ডের চারদিকে লাট্টুর মতো ঘোরার গতি । পৃথিবী সূর্যের সামনে একদিনে একবার নিজ মেরুরেখাকে বেষ্টন করে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘোরে । একে আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতিও বলে ।
২. পরিক্রমণ গতি :
সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করার গতি । পৃথিবী আবার এক বছরে একবার সূর্যকে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রদক্ষিণ করে । একে বার্ষিক গতিও বলে । সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই আবর্তন ও পরিক্রমণ এই দুই গতিই অবিরাম একসঙ্গে চলছে ।
নক্ষত্রমণ্ডলীয় গতি ( Galactic Movement ) :আবর্তন ও পরিক্রমণের সঙ্গে সমস্তগ্রহ ও উপগ্রহসহ সমগ্র সৌরজগৎটি একটি নির্দিষ্ট পথে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে একটি কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে চলেছে । একে গ্রহদের নক্ষত্রমণ্ডলীয় গতি বলে । এতে সময় লাগে ২২ কোটি বছর । |
সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহদের গতি :
NASA প্রদত্ত তথ্যানুসারে সৌরজগতের ৮ টি কুলীন গ্রহ ও ৫ টি বামন গ্রহের আবর্তন ও পরিক্রমণের দিক , গতিবেগ ও সময়ের বিস্তর পার্থক্য দেখা যায় । এখানে সেগুলি ছকের আকারে দেওয়া হল ।
কুলীন গ্রহ | বুধ | শুক্র | পৃথিবী | মঙ্গল | বৃহস্পতি | শনি | ইউরেনাস | নেপচুন |
গতির দিক | প. - পূ. | পূ. - প. | প. - পূ. | প. - পূ. | প. - পূ. | প. - পূ. | দ. - উ. | প. - পূ. |
আবর্তন কাল | ৫৮ দিন ১৭ ঘ. | ২৪৩ দিন | ২৩ ঘ. ৫৬ মি. ৪ সে. | ২৪ ঘ. ৩৭মি. | ৯ ঘ. ৫০ মি. | ১০ ঘ. ২৫ মি. | ১৭ ঘ. ১৪ মি. | ১৬ ঘ. |
পরিক্রমণ কাল | ৮৮ দিন | ২২৫ দিন | ২৬৫.২৫ দিন | ৬৮৭ দিন | ১২ বছর | ২৯.৫ বছর | ৮৪ বছর | ১৬৫ বছর |
পরিক্রমণ বেগ | ৪৭.৯ | ৩৫.০ | ২৯.৮ | ২৪.১ | ১৩.১ | ৯.৬ | ৬.৮ | ৫.৪ |
বামন গ্রহ | সেরেস | প্লুটো | হাউমেয়া | মাকেমাকে | এরিস |
গতির দিক | প. - পূ. | প. - পূ. | প. - পূ. | প. - পূ. | প. - পূ. |
আবর্তন কাল | ৯.১ ঘ. | ৬.৩৯ দি. | ৩.৯ ঘ. | ২২.৫ ঘ. | ২৫.৯ ঘ. |
পরিক্রমণ কাল | ৪.৬ বছর | ২৪৭.৯ বছর | ২৮১.৯ বছর | ৩০৫.৩৪ বছর | ৫৬১.৪ বছর |
• আবর্তন ও পরিক্রমণ কাল পৃথিবীর সাপেক্ষে • পরিক্রমণ বেগ কিমি / সেকেন্ডে • পূ . = পূর্ব দিক , প . = পশ্চিম দিক • উ . = উত্তর দিক , দ . = দক্ষিণ দিক ** মঙ্গল ও পৃথিবীর মেরুরেখার অবস্থান ও আবর্তন কাল একই। |
১. আবর্তনের দিক :
অধিকাংশ গ্রহ সূক্ষ্মকোণে হেলে থাকায় পৃথিবীসহ ৬ টি কুলীন গ্রহ ও সমস্ত বামন গ্রহ পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে আবর্তন করতে করতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে । উল্লম্ব রেখার সঙ্গে গ্রহগুলির মেরুরেখার কৌণিক মান বিভিন্ন হওয়ায় এদের আবর্তন দিক পালটে যায় । যেমন — শুক্র প্রায় এক সরলকোণে থাকায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং ইউরেনাস এক সমকোণে থাকায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে আবর্তন করে । বৃহস্পতি ও শনি সুবিশাল হওয়ায় আবর্তন বেগ অত্যধিক ও আবর্তন কাল খুব কম ।
২. আবর্তন ও পরিক্রমণকাল :
কুলীন গ্রহগুলির মধ্যে বৃহস্পতির আবর্তন সময় সবচেয়ে কম এবং শুক্রের সবচেয়ে বেশি । নেপচুনের পরিক্রমণ সময় সবচেয়ে বেশি এবং বুধের সবচেয়ে কম । বুধ সবচেয়ে দ্রুতগামী গ্রহ । বামন গ্রহগুলির মধ্যে হাউমেয়ার আবর্তন কাল সবচেয়ে কম এবং প্লুটোর সবচেয়ে বেশি । সেরেসের পরিক্রমণের সময় সবচেয়ে কম লাগে । পৃথিবী ও মঙ্গলের আবর্তনের সময় প্রায় সমান । সমস্ত গ্রহের আবর্তনের চেয়ে পরিক্রমণের সময় বেশি । তবে শুক্রের একপাক পরিক্রমণের চেয়ে একবার আবর্তনের সময় বেশি । তাই শুক্রের ১ বছরের চেয়ে ১ দিন বড়ো হয় । রাক্ষুসে গ্রহ হলেও প্রচণ্ড আবর্তন বেগের জন্য বৃহস্পতি ও শনির আবর্তনকাল খুব কম ।
৩. পরিক্রমণ বেগ :
সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান ও দীর্ঘতম কক্ষপথের বৃহস্পতি জন্য নেপচুনের পরিক্রমণ বেগ সবচেয়ে কম এবং সূর্যের সবচেয়ে কাছে অবস্থান ও ক্ষুদ্রতম পরিক্রমণ পথের জন্য বুধের পরিক্রমণ বেগ সবচেয়ে বেশি ।
পৃথিবীর গতি সম্বন্ধীয় পর্যবেক্ষণের ইতিহাস :
মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের নক্ষত্র , গ্রহ , উপগ্রহের অবস্থান , আবর্তন ও পরিক্রমণ সম্পর্কে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে নানান ধারণা প্রচলিত ছিল । ধারণাগুলি দু'প্রকার – পৃথিবীকেন্দ্রিক ও সূর্যকেন্দ্রিক ।
( ক ) পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ( Geocentric Universe ) :
খ্রিস্টজন্মের ১০০০ বছর আগে থেকে সাধারণ মানুষ , পণ্ডিত , দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদগণ মনে করতেন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী একটি স্থির গ্রহরূপে দাঁড়িয়ে আছে । আর সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ , উপগ্রহ , গ্রহাণু , উল্কা , ধূমকেতু সবকিছুই একদম বৃত্তাকার নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে অবিরাম ঘুরছে । এই সময় সূর্য ও চাঁদকে গ্রহ হিসেবে গণ্য করা হয় । পৃথিবী একস্থানে স্থির থাকায় এবং তার চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রদক্ষিণ করায় আকাশে প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্যোদয় হয়ে পশ্চিমদিকে সূর্যাস্ত হয় ।
• প্রাচীন যুগে হোমার , হেসিউদ , ডেমোক্রেটাস খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গ্রিক দার্শনিক থালেস , অ্যানাক্সিম্যনডার পরবর্তীকালে প্লেটো প্রমুখরা বলেন যে , পৃথিবী মহাশূন্যে ভাসছে ও তার চারিদিকে জ্যোতিষরা ঘুরছে । তবে তাঁরা কোনো যুক্তি দিতে পারেননি ।
• জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ ইউডোেক্সাস ( ৪০৯-৩৫৬খ্রি.পূ . ) সর্বপ্রথম সৌরজগতের মডেল প্রস্তুত করেন , যেখানে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য , চাদ , ৫ টি গ্রহ ও নক্ষত্রগুলি ২৭ টি কক্ষপথে বিভিন্নভাবে হেলে থেকে বিভিন্ন গতিতে আবর্তন করছে ।
• গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ( ৩৮৪-৩২২খ্রি.পূ .) পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণার পক্ষে বলেন , মহাবিশ্বের মাঝখানে পৃথিবী রয়েছে ও তাকে ঘিরে থাকা ৫৫ টি পূর্ণ বৃত্তাকার কক্ষপথে চাঁদ , অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রগুলি প্রদক্ষিণ করছে ।
এরিস্টটল |
• ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরীয় জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমি সর্বপ্রথম পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা প্রবর্তন করেন । তিনি বলেন , গোলাকৃতি পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে । তাকে কেন্দ্র করে সূর্যসহ জ্যোতিষ্কগুলি উপকেন্দ্রিক কক্ষপথে পাক খাচ্ছে । পৃথিবী ঘুরতে পারে না , ঘুরলে মানুষ টের পেত । খ্রিস্টীয় চার্চ এই ধারণাকে সমর্থন করে । ধর্মভীরু মানুষ ১৫০০ বছর টলেমির ধারণাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি এবং বিরোধিতা করেনি ।
টলেমি |
( খ ) সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ( Heliocentric Universe ) :
এই মতবাদ অনুসারে , পৃথিবী স্থির নয় , গতিশীল । পৃথিবী সহ সমস্ত গ্রহ , উপগ্রহ , গ্রহাণু , উল্কা , ধূমকেতু নির্দিষ্ট কক্ষপথে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট গতিতে সূর্যের আকর্ষণে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে । সেই সঙ্গে সূর্যের টানে সমস্ত গ্রহ , উপগ্রহেরা নিজ মেরুদণ্ডের চারপাশে আবর্তন করে । এভাবে পৃথিবী নিজ মেরুরেখার ওপর একদিনে আবর্তন করতে করতে ১ বছরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে পরিভ্রমণ করে ।
• খ্রিস্টজন্মের ৩০০ বছর আগে গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিসটারচাস ( ৩১২-২৩০ খ্রি.পূ. ) সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা বলেন । তাঁর মতে , পৃথিবী নয় , সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে ।
• পরবর্তীকালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ( ৪৭৬-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ ) সর্বপ্রথম বলেন , “ পৃথিবী স্থির নয় , এটি গতিশীল এবং পৃথিবী প্রতিদিন একবার করে নিজ অক্ষে পাক খায় ” ।
কোপার্নিকাস |
• আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস ( ১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি . ) ১৫১৪ সালে ' De Revolutionibus 'গ্রন্থে সর্বপ্রথম সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা প্রবর্তন করেন । প্রমাণ করে বলেন , মহা বিশ্বের ভর পৃথিবীতে নয় , সূর্যের কাছে রয়েছে । সূর্য ছাড়া অন্যান্য নক্ষত্রগুলি অনেক দূরে থাকায় সূর্যের টানে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ গ্রহগুলি নির্দিষ্ট পথে আবর্তন ও পরিক্রমণ করছে । কোপারনিকাসকে সমর্থন করে জার্মান গণিতজ্ঞ জোহানেস কেপলার ( ১৫৭১-১৬৩০ খ্রি .) সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন গ্রহগুলির কক্ষপথ উপবৃত্তাকার ও কক্ষের নাভিতে আছে সূর্য ।
কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা |
•ইতালীয় গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিয়ো গ্যালিলি ( ১৫৬৪-১৬৪২খ্রি .) টেলিস্লোপ আবিষ্কার করেন এবং সূর্যকে মাঝখানে রেখে অন্যান্য গ্রহদের গতি স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ করেন । তাঁর এই ধারণা টলেমি তত্ত্বের পরিপন্থী হওয়ায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ তাঁর উপর দণ্ডাদেশ দেয় । অবশেষে ৩৬০ বছর পর ১৯৯২ সালে ভ্যাটিকান পোপ এই সত্যকে স্বীকার করে ।
• ব্রিটিশ পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ স্যার আইজ্যাক নিউটন তাঁর ' Principia ' গ্রন্থে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাকর্ষ সূত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে , মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু প্রতিটি বস্তুকে আকর্ষণ করছে এবং এই আকর্ষণের প্রভাবেই বৃহদাকার সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চেয়ে অনেক ছোটো গ্রহ , উপগ্রহগুলি ঘুরছে ।